রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৩
সুপারম্যান...!
খুব ছোট্টবেলায় একদিন আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম। হারিয়ে যাবো বলে হারিয়ে যাইনি... মিছিলে গিয়েছিলাম... তখন মিটিং-মিছিল কি তা বুঝার মত ক্ষমতা ছিলনা আমার। শুধু দেখতাম একদল লোক আসত বাবার কাছে, কিছু একটা নিয়ে তারা খুব উদ্বিগ্ন থাকতো, বিমর্ষ থাকতো...বাবাকেও দেখতাম কি যেন ভাবতো সারাক্ষন। আমি জানতে চাইলে বলতো “তুমি এখন এসব বুঝবেনা মা... আর একটু বড় হও তখন বুঝবে...তোমাকে যে বুঝতেই হবে”...! সেদিন আমাদের বাড়ির নিকটস্থ এক বাজারে মিটিং হবে... “ক্ষেতমজুর সমিতির” মিটিং, সাজ সাজ রব, যার কিছুটা প্রভাব পরেছে আমাদের বাড়ীতেও কারণ আড়াই হাত লাঠি বানানোর কাজ চলছে আমাদের বাড়ীতে...আমার খুশি আর ধরেনা... একবার এই চাচার কাছে যাই লাঠি দেখি আর একবার আর একজনের কাছে... এভাবে সেই সময় এলো আমিও বাবার সাথে যাবো কিন্তু কেউ যেতে দেবেনা... আমিতো যাবই...শেষে বাবা বললেন ঠিক আছে যাবে কিন্তু আমি যখন চলে আসতে বলবো চলে আসতে হবে... আমি বললাম যে আমি মিটিং দেখেই চলে আসবো...! মঞ্চের একপাশে আমাকে বসিয়ে বাবা মঞ্চে উঠলেন...একে একে “ক্ষেতমজুর সমিতির” সিনিয়র নেতারাও উঠলেন...যাদের সবার কাঁধে চড়েছি আমি...! আমি তো তাদের দেখে লাফিয়ে উঠলাম, মিটিং শুরু হলো...একের পর এক বক্তব্য চলছে...সবাই হাত নেড়ে নেড়ে কি সব কঠিন কঠিন কথা বলছে সব আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে... সব শেষে বাবার পালা... তিনিও দেখি হাত নেড়ে কি সব শক্ত কথা বলছেন... কথার মধ্যে কি ভয়ানক তেজ আর ক্ষোভ, এ যেন আমার বাবা না... এ এক অন্য মানুষ... বাবা ভুলে গেলেন আমার কথা... এক সময় বাবা কি যেন ঘোষনা দিলেন সাথে সাথে ২/৩ হাজার মানুষ এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে লাইন ধরে আগাতে লাগলো...সবার লাঠিগুলো উপর দিকে... মুখে শ্লোগান... “আড়াই হাত লাঠি ধরো, খাশ জমি দখল করো”... “কেউ খাবে কেউ খাবে না, তা হবেনা তা হবেনা” “দুনিয়ার মজলুম, এক হও এক হও”...! আমার একটুও ভয় লাগছেনা... আমিও মিছিলের ভেতরে ঢুকে গেলাম, আমার দিকে কারো খেয়াল নেই...সবাই একতালে একছন্দে এগিয়ে চলছে...আমি ভয় পাচ্ছিনা কারন একটাই... বাবা-কাকা রা সবাই তো সামনে আছে! এভাবে মিছিলের সাথে কখন বাড়ি পার হয়ে ৩ কিঃ মিঃ দূরে আর একটা বাজারে চলে গেছি... তখন রাত ৮টা... বাড়ীতে কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেছে...মাইকিং এর প্রস্তুতি চলছে...এমন সময় পাশের বাড়ীর কাজের ছেলে (এখনকার ভাষায়) আমরা যাদের কোলে পিঠে চড়ে মানুষ “তারা মিয়া” (তারো ভাই) এর কাধে চড়ে আমি এসে হাজির। ঘড়ির কাঁটা তখন ১০টা ছুঁই ছুঁই করছে... বাবা কেও বিমর্ষ দেখাচ্ছে... মায়ের বকুনি খেয়ে কপালে হাত দিয়ে শুয়ে আছেন... তারো ভাইয়ের কাঁধ থেকে এক হেচকা টানে “মা” আমাকে নামিয়ে আমার পিঠের উপর দিয়ে এক মহুর্তের জন্য সিডর বইয়ে দিলেন, আমাকে সেইফ করার জন্য তারো ভাই মাঝখানে এলেন বাকিটা উনার উপর দিয়েই গেল আমি তখন দরজার পেছনে সেইফ জোন এ লুকিয়ে রইলাম কিছুক্ষন...অবশেষে আমার দাদী আমাকে আবিস্কার করে হাত মুখ ধোয়ালেন খাওয়ালেন ঘুম পারালেন। এইখানে একটা প্রশ্ন আসতেই পারে যে তারো ভাই আসলো কোত্থেকে? বলছি... মিছিলটা যখন বাজারে গিয়ে শেষ হলো সবাই যার যার মত চলে যেতে লাগলো দেখি আমার পাশে কেউ নেই... তখন সত্যি সত্যি ভয় পেলাম কিছু না ভেবেই কান্না শুরু করে দিলাম... এমন সময় পাশ দিয়ে তারো ভাই যাচ্ছিল... সে ভাবলো এই অন্ধকার-এ কে কাঁদছে দেখি তো... বলে সে কাছে আসলো... টর্চ এ চাপ দিয়ে দেখে আমি... আমাকে দেখে তার কি হা হুতাশ...তুমি এখানে কেন? হায় হায় রে... মামী তো (আমার মা) আস্ত রাখবেনা, এই বলে আর দেরী না করে আমাকে কাঁধে তোলে নিল।
আমি এখন অনেক বড় হয়েছি... বাবা কাকা রা সবাই এখন অন্য ভুবনের বাসিন্দা। এখন আমি বুঝতে পারি তাঁদের মিটিং-মিছিলের কারণ, তাঁদের বিমর্ষ থাকবার কারন গুলোও এখন আমার কাছে স্পষ্ট... বাবা সরাসরি অস্ত্র হাতে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেননি,যা করেছেন সেটাও নেহায়েত যুদ্ধের চেয়ে কোন অংশে কম না... জীবনের ঝুকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চাল, ডাল, টাকা-পয়সা যোগার করেছেন। সময় মত পৌছেও দিয়েছেন মুক্তিদের হাতে। কিন্তু কোনদিন বাবা এসব স্বীকার করতে চাইতেন না... খুব বেশি প্রচার বিমুখ ছিলেন আমার বাবা। যখন দেখি মুক্তি যুদ্ধের বিরোধীরা মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়ে রাজ্যের সব সুবিধা ভোগ করছে তখন বাবার প্রতি খুব রাগ হয় আমার... অনেকেই বাবাকে সনদ নেয়ার জন্য জোর করেছেন তখন এই ভেবে যে উনি যা করেছেন তাও একধরনের যুদ্ধ... বাবার বিবেক সায় দেয়নি... তাই তিনি নেননি...এই একটা জায়গায় তিনি ছিলেন আপোষহীন... নিজের বিবেকের কাছে সবসময় পরিস্কার থেকেছেন... আমাদেরকেও সে ভাবেই বড় করার চেষ্টা করেছেন। কতটা হয়েছি জানিনা...!
আজ এতসব কথা বলছি একটা কারনে- ৩০ বছর আগে স্বাধীনতার ১০ বছর পর বাবা-কাকা-দের প্রতিবাদ যাদের বিরুদ্ধে ছিল এখনও তো তারাই বহাল তবিয়তেই আছে...! এখন আমি আমার অল্প জ্ঞান দিয়ে যতটুকু বুঝি তা হলো এই পৃথিবীতে দুইটাই শ্রেনী আছে...
১. শোষক শ্রেনী
২. শোষিত শ্রেনী।
আর সেটা সৃষ্টি লগ্ন থেকেই। মাঝে মুক্তিকামী মানুষগুলো তাঁদের জীবনটা কে বলির পাঠা ভেবে বলি দিয়েছে আর কিছুই না...! আমাদের দেশের কথাই বলি কি লাভ হয়েছে ৩০ লক্ষ প্রাণের বিসর্জন দিয়ে? যে স্বপ্ন নিয়ে সাধারন মানুষগুলো কি অবলীলায় তাঁদের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করলো আসলেই কি আমরা সেই স্বাধীনতার স্বাদ কি পেয়েছি গত ৪২ টা বছরে? মুক্তিকামী মানুষগুলো স্রেফ চেয়েছিলেন যাতে আমরা (পরের প্রজন্ম) ভাল থাকি... কিন্তু কতটা ভাল আছি আমরা? আমরা তো আজও শোষন আর নিপীড়ন থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারছিনা... একসময় বিনদেশীরা শোষন করতো, রক্ত চুষে খেতো, এখন নিজেরাই নিজেদের রক্ত দিয়ে রক্তস্নান করে বড় বড় বক্তৃতা দিচ্ছি, পরিশুদ্ধ হওয়ার শ্লোগান দিচ্ছি... ছিঃ...! আমার এখন ছিঃ বলতেও ঘেন্না লাগে। ছিঃ তো মানুষের জন্য বলা কিন্তু...!
১৯৭১ এর পর যা যা হয়েছে, যতগুলো সাধারন মানুষের প্রাণ গেছে সে সবের দায় কার? কে নেবে ওইসব খেটে খাওয়া সাধারন মানুষদের পরিবারের দায়িত্ব? আছে এমন কোন দল/শ্রেনী এ দেশে? রাজনীতি নিয়ে আমি কোন কথা বলিনা কারন এই জিনিষটা আমি বুঝিনা। যে জিনিষ বুঝিনা সেই জিনিষ নিয়ে কথা বলার সাহস হয়না আমার। আমি শুধু বুঝি জাতি হিসাবে মানুষ হিসাবে আমার আজন্ম অধিকার যা ৩০লক্ষ প্রানের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে, একটা স্বাধীন দেশ... একটা মানচিত্র... একটা পতাকা... সেই স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে আমি পেতে চাই আমার সব ধরনের নিরাপত্তা, আমার মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য সুস্থ্য একটা পরিবেশ। যারা এ দেশের মাথা কিনে নিয়েছে বলে ভাবে, যারা দেশটাকে নিজেদের বাপ-দাদার সম্পত্তি মনে করে যা খুশি তাই বলছে, দিন কে রাত আর রাত কে দিন করছে তাঁদের কাছে আমার একটাই প্রশ্ন, বুকে হাত দিয়ে বলুন তো “আপনারা যার যার নিজের বিবেকের কাছে কতটা পরিস্কার”?
১৯৭১-কে বাঙ্গালী জাতি কখনও ভুলতে পারবেনা তারপরও একটা বিষয় আমাকে স্বস্তি দেয় যে তখন যা হয়েছে তা তো বিনদেশীরা করেছে... তাঁদের তো আর আমাদের প্রতি কোন মায়া-মমতা থাকার কথা ছিলনা কিন্তু ২০১৩ সালে এই ডিজিটাল বাংলাদেশ এ যা হচ্ছে, আমাদের অমুক দল তমুক দলের সোনার ছেলেরা যা করছে তা কি ’৭১ কেও হার মানায়না? যে দল এ যত বেশি লাশ পড়বে সেই দল তত বেশি লাভবান... লাশ নিয়ে এই যে একটা নোংরা প্রতিযোগিতা এটা কি আপনারা যারা রাজনীতি করেন আপনাদের ভাবায়না? আর ভাবাবে কিভাবে? লাশগুলো তো আর আপনাদের আপনজনদের কারো না... লাশগুলো তো শোষিত শ্রেণীর...যাদের জন্মই আজন্ম পাপ... তারা তো এভাবেই কুকুরের মত মরে পরে থাকবে রাস্তায়...তাইনা? যাত্রীবাহী চলন্ত বাসে যারা আগুন দিচ্ছে তারা তো আর ভিন্ন দেশ থেকে উড়ে এসে আগুন দিয়ে/বোমা মেরে আবার উড়ে চলে যাচ্ছেনা তাইনা?
এইখানেও সেই পুরনো কাহিনী, শোষক শ্রেনী আর শোষিতদের লেনা-দেনা... এই পযর্ন্ত
যত পিকেটিং –হামলা হয়েছে সেইখানে তো কোন ধনীর দুলালকে পাওয়া যায়নি... কেন? কারন তারা তো না চাইতেই সব পেয়ে যাচ্ছে আরাম-আয়েশ, গাড়ী-বাড়ী-নারী সব তাদের হাতের মুঠোয়... নামী দামী বেসরকারী বিস্ববিদ্যালয়ে পরবে আর ইয়াবার ব্যবসা করে রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ বনে যাবে। আর এক শ্রেনীর মানুষের দেয়ালে যখন পিঠ ঠেকে যায় তখন স্বভাবতইঃ সে দিগ্ববিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে পরে... আর শোষক শ্রেনীর টার্গেট-এ পরিনত হয়ে সহজেই জীবন জীবিকার তাগিদে মোটিভেট হয়... যা বলে তাই করে বিনিময়ে ভাল থাকার প্রতিশ্রুতি...বিলাস-বহুল জীবনের হাতছানি... মন্দ কি?
আমার খুব কাছের মানুষ বলে আমার মাঝে কোন চেতনা নেই, স্বদেশ-প্রেম নেই। হ্যাঁ কিচ্ছু নেই আমার মাঝে... আমি এখন এই দেশ থেকে পালাতে পারলে বেঁচে যেতাম, জানি পৃথিবীতে এমন কোন দেশ নেই যেখানে শোষক শ্রেনী নেই তাও শান্তি এই ভেবে যে এরা আমার কেউ না... এদের অন্যায় অত্যাচার সইতেই হবে...ব্যাস...! আমার মাঝে যা ছিল চেতনা, দেশপ্রেম, স্বপ্ন ওসব অনেক আগেই বস্তাবন্দী করে ডাস্টবিন-এ ফেলে দিয়েছি... এসব শব্দগুলো আমার কাছে এখন খুব পুরনো আর সস্তা/বস্তা পঁচা মনে হয়... এসব শুধু বড় বড় লেকচার-এ কাজে লাগে... আমি কখনও লেকচার দেবনা তাই এগুলো আমার কাজে লাগবেনা...!
আমি দেশের একজন সু-নাগরিক হিসাবে নিজেকে জানি এবং মানি। এমন কোন মানুষ নেই যাদের কাছে আমি আমার যোগ্যতা অনুসারে একটা কাজের জন্য ধর্না দেইনি... সবাই শুধু নীতি কথা শুনায়...তাঁদের কথা শুনে মনে হয় নীতিতে ভাসছে দেশ... কোথাও কোন অনিয়ম নেই...! এখন আর শুধু মেধা দিয়ে চাকরী হয়না মামা-চাচার জোড় লাগে / টাকার জোড় লাগে আর এক্সট্রা যা লাগে সেটা হলো উদারপন্থী হতে হবে... ড্রেস আপ হবে এমন যাতে মেয়েদের আকর্ষনীয় জায়গা গুলো .........., বেশিরভাগ জায়গায় বিশেষ করে মেয়েদের সাথে চাকরি দেয়ার নামে যা করা হচ্ছে তা ভাবতেই আমার গাঁ ঘিন ঘিন করে। এইখানেও সেই একই কাহিনী... শোষক আর শোষিতের লীলা-খেলা। আর কিছুইনা... মেয়েরা আজ পন্য... কেউ বুঝে শখ করে পন্য হয় আবার কেউ না বুঝে/ কারো আবার অন্য কোন অপশন নেই বলে...! বেশিরভাগ জায়গায় আজ ভায়োলেশন-এ ছেয়ে আছে। যেন এটাই নিয়ম এটাই নীতি... এইতো আমার স্বাধীন দেশ... যেখানে আমরা সবাই জিম্মি শোষকদের হাতে...! আচ্ছা শোষক আর শোষিত এর অনুপাত-টা কেমন? ১০: ৯০ নাকি ২০: ৮০? আমার মনে হয় ১০% মানুষের হাতে জিম্মি আমরা ৯০% মানুষ...!
আর এই একটা কারনে আমার এখন সুপারম্যান হতে ইচ্ছে করে। এই ১০% এর একটা একটা শোষককে টুটি চেপে ধরে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে এভারেষ্ট এর সর্বোচ্চ চূড়া থেকে ফেলে দিতে ইচ্ছে করে আজন্মের মত। প্রভুকে বলি পরের জেনারেশন এ যেন প্রতিটা ঘরে ঘরে একটা করে সুপারম্যান পাঠান... না হলে এসব অপরাধী আর অপরাধের দমন সাধারন মানুষের জন্য দূরূহ কাজ হবে...! তাই বলে ভেবোনা আমি হতাশ... জানি একদিন অন্ধকার কেটে যাবে... ভোর হবেই ইনশাল্লাহ... সেদিন হয়ত আমি থাকবনা... তাও চাইবো সেদিনটা যেন খুব বেশি দূরে না হয়... আমাদের পরের প্রজন্ম যেন সুখে থাকে একটু শান্তিতে থাকে...!
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন